দখিনের খবর ডেস্ক ॥ দেশজুড়ে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। দিন দিন তা তীব্র হচ্ছে। আর করোনায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে আইসিইউ সেবা জরুরি। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের অনেক জেলা হাসপাতালেই আইসিইউ স্থাপনের মতো অবকাঠামো নেই। বর্তমানে ঢাকা ও ময়মনসিংহ ছাড়া দেশের ৬২টি জেলায় সদর বা জেলা হাসপাতাল রয়েছে। সাধারণত ওই হাসপাতালগুলোই সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের কাছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। কিন্তু করোনা মহামারী শুরুর পর যখন গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে, তখনই ওসব জেলা হাসপাতালের নানা সংকটের চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ওই হাসপাতালগুলোর এক-তৃতীয়াংশেই আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং গণপূর্ত অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলমান করোনা মহামারী মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সেজন্য জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের অবকাঠামো আছে কিনা তা যাচাইয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে অনুরোধ করা হয়। যাচাই শেষে গণপূর্ত অধিদপ্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে একটি চিঠিতে ১৯ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের অবকাঠামো না থাকার কথা জানায়। তার মধ্যে নওগাঁ জেলা হাসপাতাল রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে ওই হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে তা কেবল কাগজে-কলমেই। কারণ কর্তৃপক্ষ এখনো সেখানে ২৫০ শয্যার সেবা চালু করতে পারেনি। এ অপারগতার জন্য লোকবল ও জরুরি যন্ত্রাংশসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে। সূত্র জানায়, দেশের অনেক জেলা হাসপাতালকেই ১০০ থেকে ১৫০ বা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত করা হলেও লোকবল ও অবকাঠামো বাড়ানো হয়নি। কোনো কোনো জেলায় নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও আইসিইউ স্থাপনের জন্য সুবিধা রাখা হয়নি। বর্তমানে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বাদে দেশের বাকি ৬২টি জেলায় সদর বা জেলা হাসপাতাল রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাত্র ১৫টি সদর বা জেলা হাসপাতালে স্বল্পসংখ্যক আইসিইউ সুবিধা রয়েছে। ওসবের কিছু জেলা হাসপাতালকে সরকার সম্প্রতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নীত করেছে। সেসব স্থানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে ওসব স্থানে আলাদা করে জেলা হাসপাতাল থাকছে না। আবার অনেক জেলা হাসপাতালে আইসিইউ না থাকলেও আশপাশে হয়তো বিশেষায়িত বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, সেবাপ্রত্যাশীরা জেলা হাসপাতালগুলোতে কম যায়। তারা চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, জেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অবকাঠামোগত যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তার প্রধান হলো বেশির ভাগ জেলা হাসপাতাল ভবনগুলো পুরনো। অথচ একটি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করতে গেলে অনেকগুলো বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন যে ভবনে আইসিইউ স্থাপন করা হবে, সেটি ওই সুবিধার জন্য যথাযথ কিনা। সেখানে রোগীদের সেবা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা আছে কিনা। এমন একটি ভবন বা কক্ষ থাকতে হবে, যেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থাসহ বিশেষ কিছু কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য থাকবে। তারপর সেবা চালু করার জন্য অন্য বিষয়গুলো যুক্ত করলেই সেখানে আইসিইউ সেবা দেয়া যাবে। কিন্তু বর্তমানে যেসব হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের অবকাঠামো নেই সেগুলোর ভবনগুলো অনেক পুরনো। সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন বসানো যাচ্ছে না। সংক্রমণ প্রতিরোধী যে ব্যবস্থা নিতে হয় কাঠামোগত কারণে তাও নেয়া যাচ্ছে না। পুরনো ভবনগুলো অনেক আগে নির্মাণ করায় আইসিইউর কথা তখন চিন্তা করা হয়নি। যে কারণে এখন চাইলেও ওসব ভবনে আইসিইউ ইউনিট চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে সরকারি হাসপাতালে আইসিউউ স্থাপনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (পিপিসি) মো. মাহফুজুল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, দেশের ১৯টি জেলা হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) ইউনিট ও ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। ওই জেলাগুলো হলো মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও রংপুর। অন্যদিকে করোনা মোকাবেলায় জেলা পর্যায়ের সরকারি চিকিৎসা সেবা উন্নত করার লক্ষ্যে নেয়া ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের জুনে শেষ হবে। ওই প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনা, জেলা হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ১০ শয্যার আইসিইউ ও ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট স্থাপনের কথা রয়েছে। ওই প্রকল্পের পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার’ অপারেশনাল প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মোহাম্মাদ আজিজুল রহমান সিদ্দিকী জানান, দেশের সব জেলায় সদর বা জেলা হাসপাতাল নেই। একে তো পুরনো ভবন, তার ওপর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় সবগুলোতে আইসিইউ স্থাপনও করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া জানান, অবকাঠামো না থাকায় সব জেলা হাসপাতাল অথবা সদর হাসপাতালে আইসিইউ দেয়া যাবে না। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়তাও দেখতে হবে। কেননা পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসব সুবিধা থাকায় চিকিৎসা প্রত্যাশীরা জটিল রোগে জেলা হাসপাতালে আসে না। তাছাড়া আইসিইউ স্থাপনের জন্য যে জনবল দরকার হয় তারও সংকট রয়েছে। টাকা দিয়ে আইসিইউ ইউনিট হয়তো স্থাপন করা যাবে, কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল পাওয়া কঠিন। আইসিইউ স্থাপনের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু হাসপাতালের অবকাঠামো পুরনো হলে সেখানে ওসব নিশ্চিত করা যায় না।
Leave a Reply